একটি গল্পের জন্ম-অনিতা অগ্নিহোত্রী

যশোবন্ত অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আমার মনে হচ্ছিল অনেক ক্ষণ। বড় আর বুড়ো আঙুলের মাঝখানে সরু করে একটা সিগারেট ধরে রেখেছে। আমি কুর্তার পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ টা বার করে আর এক বার বললাম, মণীষা দিদি বলেছেন আপনার সংগে দেখা করে--

একটু যেন অস্থির ভাবে হাত নাড়া দিল যশোবন্ত। কাগজটা দেখতে চায়না।

এখন আর কি দেখবেন, কি কথা বলবেন, সব তো শেষ। কালকের মধ্যে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে শালারা।

আঙুল তুলে ঢাবার পিছনদিকটা দেখাল। ভেঙে ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে। পুরোনো ইঁট, পলেস্তারার চাঙড়। বুলডোজার টা হাতার মধ্যেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। মানে, যে কোনও মুহূর্তে তেড়ে এসে কাজ আরম্ভ করে দেবে। তেল ও পোড়াতে হবেনা।

পিছনে কিচেন তো। ওটা আগে ভাংগল। ভাতে তো মারবেই। একদিন আগে মারলে শালাদের শান্তি।
যশোবন্তের মুখে একটু টক, বাঁকা হাসি।

চল্লিশ বছর এই জমিতে আছি। তিরিশ বছর লেগেছে একটা। ছাদ তুলতে খাম্বার উপর। প্রথমে আখের পাতা, তারপর টিন। মাঝখান টা কেবল পাকা হয়েছে এত বছরে। সব শেষ হয়ে গেল।

স্টেট হাইওয়ের ধার ঘেঁষে যশোবন্তের ঢাবা। অনেকটা জমি। গ্রামদেশে জমি সস্তা। চল্লিশ বছর আগে নিশ্চয়ই জলের দর ছিল। নীচু পাঁচিল চৌহদ্দির। সামনের আর পিছনের দিকটা খোলামেলা। খাটিয়া পাতা থাকে, সেগুলি দাঁড় করিয়ে রাখা। আজ হয়তো খদ্দের আসবেনা। সামনের উনুন দুটোয় আগুন পড়েনি, এখন, এত বেলাতেও। হাঁড়ি কড়াই ডেকচি প্লেট এককোণায় জমা করে রাখা। কালকের শুকনো এঁটোর উপর বড় মাছি উড়ে বেড়ায় টেবিলের তক্তায়।

কিছু বলা উচিৎ, সহানুভূতি না দেখিয়ে, তাই বলি,

হাইওয়ে টা তখনও ছিল?

যশোবন্ত লম্বা, কাঁধ পর্যন্ত চুল, এই বয়সেও কালো। কৃশ, কঠিন শরীর। লম্বাটে মুখ। চোখে খর চাউনি।
সিগারেট টাকে চপ্পলের নীচে পিষে মারতে মারতে বলে, তাহলে আর কি বুঝলেন? সেটাই তো চাল ওদের। আমি এসেছি চল্লিশ বছর। হাইওয়ের এস্টিমেট বনল এই সেদিন। এখন বলছে নকশায় আমার জমি পড়েছে, এটা জবর দখল। একটা ছাপ্পা নোটিশ ধরিয়ে দিয়ে ভাংগতে লেগেছে। তাহলে বঝুন শালা পাটিল ডাক্তার কত লোক কে কিনে রেখেছে। কালেক্টর, ইন্জিনীয়ার থেকে নিয়ে জলা পরিষদ, মিনিস্টার স--ব।

হাইওয়ের নামে এখন যে রাস্তাটা আছে, সেটা জীর্ণ, অপরিসর। ওই পথ ধরে তিনচার কিলোমিটার ডান দিকে গেলে দগড়ওয়াড়ী গ্রাম। গোঁয়ার গোবিন্দ ট্রেকার ড্রাইভার রাজু আমাকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেছে। যেহেতু আমি আসার কারণ টা ওকে বলতে চাইনি। জানতে চেয়েছিলাম আখকাটাই মজুর দের গ্রাম কোথায় । এখন দেখছি বুদ্ধির কাজ করেছি। পাটিল ডাক্তারের পসার আর প্রতিপত্তি দুটোই যে কি ভয়ানক এখানে এসে টের পাচ্ছি। চল্লিশ বছরের পুরোন ঢাবা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে জেলের ভিতর বসেই। এখানে কে কার লোক বোঝা যায় না। ডাক্তার গ্রেফতারের পর সারা এলাকায় নি:ঝুম সন্নাটা ছেয়ে আছে।

পুণে, সাতারা, সাংগলি, শোলাপুর জেলায় দুধ উৎপাদন হয়, সেখানে আছে চিনিকল গুলি আর মাইলের পর মাইল আখের ক্ষেত। মহারাষ্ট্রের এই সম্পন্ন দুধ চিনির বলয় কে আখকাটার শস্তা মজুর জোগায় মারাঠওয়াড়ার জেলা গুলি--লাতুর, ওসমানাবাদ, বীড, ঔরংগাবাদ। গরিব ভূমিহীন, আদিবাসী মজুর রা পরিবার কে পরিবার দাদন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ধনী চাষির ক্ষেতের আখ কাটতে, মহাজনের বা নিজেদের বলদ গাড়ী, আর জনপ্রতি একটা করে কাস্তে। স্থানীয় মজুরের রেট অনেক বেশি। তারা আখ কাটাই করবেনা। এই ভিন জেলার মজুর দের অবস্থা যে কি সাংঘাতিক খারাপ তা চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। চিনি কারখানার লাগোয়া জমিতে এরা পাতার ছাউনিতে বাস করে পুরো কাটাইয়ের মরসুম, না আছে খাওয়ার জল, না কল পায়খানা। জন্তু ঢুকে খাবারে মুখ দিচ্ছে। ঘরের তো দরজা নেই। ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। আখ কেটে গাড়ী বোঝাই করে দিলে কারখানায় রওনা হয়ে যায়, আবার খালি গাড়ি ফিরে এলেই ওরা দৌড়োয় কাটাই করতে। চিনি কলের মড়ি গোলা লাল জল আঁজলা ভরে খায় ওরা তেষ্টার সময়। নিজেরাই বলল , গলা বুক জ্বলতে থাকে যখন নামে সে জল। বিয়েবাড়ী ছিল আত্মীয়ের। তাই কাটাই মজুরের এক পরিবার ফিরছিল কারখানার কাছে তাদের ঝুপড়িতে। রাজুর ট্রেকারে তারা চড়ে বসেছে আহমদনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে। যাবে বীড জেলার সীমানায়, মহেশ্বর সমবায় চিনিকলে। তারা যখন নামল, আমিও গেলাম ঝুপড়ি গুলি দেখতে।

রাজুকে বেশি ভাড়া দিচ্ছি তবু সে গাঁই গুঁই করে , দাঁড়াবেনা। তার লোকসান হচ্ছে। হাটের দিন। আরও বেলা হলে সওয়ারী পাবেনা। রাজুর ঠেট গাঁওয়ালী মারাঠী শুনতে শুনতে আমার তো নাভিশ্বাস। হিন্দি বেল্টে ঘুরি বলে কাজ চালানোর মত হিন্দি জানি। তাই বলে রাজুর মারাঠী! যশোন্তের সংগে কথা বলে ধড়ে প্রাণ এল। ও তো স্থানীয় নয়। বিহারের মানুষ। আরা জেলা থেকে বাবা মায়ের সংগে এসেছিল দিনমজুরি করতে। তারপর বড় হয়ে ঢাবা খুলে বসে গেছে। যাই হোক মিথ্যে বলে রাজুর ট্রেকারে যখন চড়েছি, চড়িয়েও দিয়েছে মণীষা আত্রে তাঈ (দিদি)এর অফিসের লোক, মিথ্যেটা বজায় রাখতে ই গেলাম দগড়ওয়াড়ী গ্রাম। ওখানে আমাকে রেহাই দিয়ে গুণ্ডা প্রকৃতির রাজু ট্রেকার জীপ নিয়ে আগে চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ট্রেনি জার্নালিস্ট হয়ে যখন জয়েন করি তখন মিথ্যে কি, সত্যিকথা বলতে গিয়েই তুৎলে যেতাম। কথাই বলতে পারতাম না ভালো করে। ইন্দ্রদা বলেছিলেন, স্টোরির জন্য চোখের পলক না ফেলে মিথ্যে বলবি আর জেনুইন সেলিব্রিটি ছাড়া সবাইকে ইনসাল্ট করবি। কনফিডেন্স বাড়বে। ইন্দ্রদার শিক্ষা পুরোপুরি হজম করার আগেই দু নম্বর টা ট্রাই করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ি। চাকরি যায়নি অবশ্য, কিন্তু ন্যাশনাল রুরাল বীট এ পাঠিয়ে দিল অফিস। গত পাঁচ বছরে মিথ্যে বলাটাও রপ্ত করেছি।

আখ কাটতে যারা মহেশ্বর চিনিকলে গেছে, সেই শ্রমিকদের মধ্যে অনেকের বাড়ী এই দগড়ওয়াড়ী গ্রামে। উফফ, কি জলের কষ্ট রে বাবা। একমাত্র কুয়োটার কাছে জলের ক্যান বালতির লম্বা লাইন দেখে বুক হিম হয়ে গেল। তেষ্টা পেয়েছে বলায় আধ গেলাস ঘোলাটে জল এনে দিল। না পারি খেতে, না পারি ওদের সামনে ফেলতে। কী ভাববে। শুনলাম ট্যাংকার আসে পনের দিনে একবার। স্নানের চিন্তা ওদের দূর অস্ত। যাদের বাবা মা আখ কাটতে গিয়ে এখনও ফেরেনি, সেই সব বাচ্ছাদের স্কুল ঘরে রেখেছে একজন টীচারের জিম্মায়। তাদের রান্না হচ্ছে , ছেলেমেয়েরা ধরেছে আমাদের সংগে খাও। না, না, আসল কাজের তো আবার দেরী হয়ে যাচ্ছে তাই ছুতো করে পালালাম। কুড়িজন ছেলে আর দুজন মেয়ে মোটে! এসব জায়গায় মেয়ে খুঁজে পাবেন না। স্কুল টীচার অশোক মুণ্ডে বলল।
এও কি সেই পাটিল ডাক্তার আর তার চেলাদের মহিমা? জম্মের আগেই মেয়েরা নিকেশ?

অশোক কে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। কে কার লোক তো জানি না।

ও আমাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে পৌছে দিয়ে গেল বি বি বি ঢাবায়। যশোবন্ত মাহাতোর বিশুদ্ধ ভারতীয় ভোজনালয়ে। ঢাবায় যাবো শুনে অশোক আফশোষ করেছিল, ওটা তো এখন ভাঙা হচ্ছে। খাবার দাবার পাবেন না। স্কুলে খেয়ে এলেই পারতেন।  আমাকে নামিয়ে দিয়ে অশোক ও গ্রামের স্কুলে চলে গেল ফিরে।

যাক্গে। এবার পেয়েছি যশোবন্তকে। পাটিল ডাক্তারের এনিমি নাম্বার ওয়ান। মণীষা তাঈ যখন শুনলেন আমি ওই স্টোরিটাই করবো, চিঠি লিখে দিলেন যশোবন্তের নামে। বললেন, ও সব জানে। ওকে আমার নাম বলবে। অন্য কারো কাছে ভাংবেনা কি কারণে যাচ্ছ। খুব সাবধান। তুমি বাইরের প্রেস। তার উপরে মেয়ে। তোমাকে তুলে নিয়ে পুঁতে দিলেও ওখানে কেউ রিপোর্ট করবেনা লোকাল থানায়। তোমাদের টাইপ কে জন্মাতে না দেওয়াই পাটিলদের মিশন। তা তুমি তো জন্মে দিব্যি বড়টি হয়ে গেছ। আর পাটিল এখন জেলের ভিতর। তবুও। কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে লোকটা। সেই টাকা খুঁটে খেয়ে এখনও আশপাশের এলাকার চলে যাচ্ছে। ওখানে সবাই পাটিলের লোক। আমিও তো দাগী। মণীষা হাসছিলেন। ওরা আমাকে পেলেও ছাড়বেনা। তাই আমিও কদিন পুণেতে থাকবো। নাহলে তোমাকে সংগে করে নিয়ে যেতাম।

চিন্তা করবেন না। আমার অভ্যেস আছে। সাহস দেখিয়ে বললাম। কিন্তু বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠেনি কি? যেখানে যাবো, সেখানে মণীষার মত ডাকসাইটে আ্যকটিভিস্ট ও এখন যাওয়া আ্যভয়েড করছেন।

চীফ এডিটর বলেছিলেন, মারাঠওয়াড়া হল বছরের এই সময় স্টোরির সোনার খনি। সব পাবে। চাষিদের সুইসাইড। মাইগ্রেশন। শিশুর অপুষ্টি। মৃত্যু। জলকষ্ট। কিন্তু না জন্মানো মেয়েদের যে মারণভূমি এ অঞ্চলে তা বোধহয় উনি মানে শমিতা নন্দী ও জানেন না। আমিও পুরো টা জানতাম না। কিন্তু পুণে তে পৌঁছে আমি জ্যাকপট হিট করলাম। স্থানীয় কাগজের সামনের পাতায় পাটিল ডাক্তারের আ্যরেস্টের খবর। জেল কাস্টডি হয়েছে। পুলিশ কাস্টডি চায়ইনি। তখন ই মনস্থির করে নিলাম ডাক্তারের যেখানে বাড়ী সেই জেলায় যাবো। অনেক টা দূর অবশ্য, পুণে থেকে। তাতে কি! কষ্ট না করলে ভালো স্টোরি হয়?

মণীষা তাঈএর বাড়ী খুঁজে গেলাম। উনি তখনও ফোনে, টিভি ক্যামেরার সামনে ইন্টার ভিউ দিয়ে চলেছেন। আমাকে পাশের ঘরে বসিয়ে নিজে আমার কাছে উঠে এলেন কথা বলতে। চূড়ান্ত সাবধানতা।

সাতারার নীল পাহাড়শ্রেণী পেরোবার পর থেকেই মালভূমির যে রূপ দেখতে দেখতে এসেছি, তা এই জেলাতেও বদলায়নি। বৈশাখের আরম্ভ। খোলা ট্রেকারে সারাদিন রোদ বর্ষেছে গায়ে মাথায়। রাজু কট্কট্ করবে তাই মাথায় তোয়ালে চাপিয়ে বসেছিলাম। মাথায় দপদপে ব্যথা এখন। জলহীন রুক্ষ পৃথিবী, আদিগন্ত কালো মাটি,খাঁ খাঁ করছে রোদে। আকাশে মেঘের ছিটে ফোঁটা নেই। বুক হিম হয়ে আসে এমন গভীর নীল আকাশ দেখলে। বাংলার মত এখানে মাঝে মধ্যে কালবৈশাখী এসে জীবন জুড়িয়ে দিয়ে যায়না। ফসল উঠে যাওয়া আখের ক্ষেতের রিক্ত একাকিত্ব। তুলোর ক্ষেতের বাতাসে কাপাসের আঁশ উড়ে বেড়াচ্ছে। কালো মাটির উপর ঢিপি হয়ে আছে মাড়াই হওয়া আখের হলদে ছিবড়ে। পালে পালে ছাগল চরছে। মুখ দিচ্ছে এড়বাবুলের ঝোপে। পানীয় জলের খোঁজে মেয়েরা চলেছে ঘড়া ক্যানেস্ত্রা হাতে। চিনির কারখানা থেকে ঝড়তি পড়তি আখ নিয়ে ফিরে আসছে বলদ গাড়ী। বড় বড় শিংঅলা বলদ। তাদের গলায় ঘন্টা বাজছে টং টং।

যশোবন্ত বলল, মরসুম শেষ তাই, না হলে আখের গাড়ীর জন্য এপথে চলা দায়। ওর জীপ গাড়ী খানা নাকি পঁচিশ বছর পুরোনো। নিজে চালায় তাই এখনো থামেনি। আমাকে নিয়ে চলেছে ঢাবা থেকে বাঁ দিকের পথ ধরে--জেলা সদরে। পথে শিরুর কাসারে ঘুরিয়ে দেখাল- সারি সারি বিরাট বাড়ি, ঝকঝকে, দামী মারবেলের মেঝে-- গুনছিলাম। কুড়িখানা হাসপাতাল দুশো মিটারের মধ্যে। এত হাসপাতাল, কিন্তু রোগী কোথায় পায়? শিরুর তো তালুকা শহর, বড় সড় একটা গ্রামের মত, মহকুমাও নয়।

যশোবন্ত হাসল আমার প্রশ্নে।

রোগ তো একটাই এখানে। মারো আর মারো।

ডাক্তারদের একজন মাত্র আ্যালোপ্যাথ। বাকিরা? হোমিও, আয়ুর্বেদিক, য়ুনানী। ভিতরে গিয়ে দেখুন, কোনও যন্ত্রপাতি নেই, এক্সরে মেশিন, কি ইসিজি নিদেন প্যাথোলজির ল্যাব।

তবে?

এসব হল খোল, বুঝলেন ম্যাডাম? শাঁস টা হল জেলা সদরে। এরা হল পাটিলদের দালাল। দুহাজার টাকা নেবে আর আপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেবে সদরে। এদের কাছেই জীপ ট্রেকার বোঝাই হয়ে আসে শ্বশুর শাশুড়ী স্বামী স্ত্রী। আগেকার দিনে মেয়ে জন্মাবার পর মুখে নুন দিত, কিংবা বালিশ চাপা, আমাদের ওদিকে দুধের ঘটি ঠেসে ধরে শুনতাম মুখে। নেহাৎ হিম্মত নেই যাদের তারা মেয়ে সন্তান হলে উপোস করিয়ে মেরে দিত। এখন টেকনোলজি এসেছে, তালেবর ডাক্তার বনে গেছে শয়তানের হাত। এখন জন্মানোর আগেই মেয়ে সন্তানের নিকেশ! ঘরে ঘরে দেখবেন, গাড়ী স্কুটার, ছিমছাম সংসার, একটি কি দুটি ছেলে। মেয়ে নেই। ভেতরের খবর নিন, বউয়ের কতবার মিসক্যারেজ হয়েছে, জানতে পারবেন আসল খবর। সরকার আইন করেছে, কালেক্টার কে পাওয়ার দিয়েছে, জন্মের আগে ছেলে কি মেয়ে জানাতে পারবেনা-- তবু দিনে একশো দেড়শো আল্ট্রাসাউন্ড আর আ্যাবরশন চলেছে। কি করে? ডাক্তার আগে মুখে বলে দিত ছেলে না মেয়ে, এখন ইশারা করে, ঠারে ঠোরে বলে, নিজের হাতের তালু তে লিখে পেশেন্ট পার্টিকে দেখিয়ে দেয়-- এসব ধরেছি আমরা লুকোনো ক্যামেরায়।

মেয়ে গুলো গর্ভ ধরতে ধরতে ক্ষয়ে যাচ্ছে-- যতক্ষণ না ছেলে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ী ছাড়বেনা তাকে। আমাদের জেলা হল নরকের কুণ্ড। সবচেয়ে বেশি মেয়ে জন্মের আগে খালাস এখানে। দালাল ডাক্তার জীপ টেম্পো মিলে জমজমাট ব্যবসা। সদরের হোটেল গুলোতে গিজগিজ করছে অ্যাবরশন পার্টি। আমি খবর সাপলাই করি। মণীষা ম্যাডামের দল আছে, লুকিয়ে ক্যামেরা নিয়ে পেশেন্ট সেজে ঢুকছে, হাতে নাতে প্রমাণ সহ ধরছে-- কিন্তু পুলিশ কেস নেয়না, যদি ও বা নিল, কোর্টে গিয়ে ডাক্তার বাবু খালাস। ক্লিনিকের মেশিন রেজিস্টার করার কথা আইনে, করাচ্ছেনা। একটা মেশিন দেখিয়ে দশটা মেশিন লাগাচ্ছে। ক্লিনিক সীল করে দিলে বাইরে ফল্স দরজা লাগিয়ে ভিতরে ব্যবসা চালাচ্ছে-- কত আর বলব? মেয়ে মারার যজ্ঞে সব মেতেছে - ঠেকাবে কে? কথায় বলে না, সব অস্ত্রের মোকাবিলা আছে, আটকানো যায়না কেবল সোনার তরোয়াল কে।

সদরের উপকণ্ঠে ডক্টর পাটিলের খামার বাড়ী। সামনে পুলিশ পাহারা। তবু গাড়ী দাঁড়িয়ে অনেক। বন্ধু
আর স্বজন তো কম নয় পাটিলের। জীপ স্লো করে নেয়, যশোবন্ত। আমাকে বলে আড়চোখে দেখুন। ওই বাউণ্ডারির কাছে বড় ইঁদারা। ওটা ভরে থাকত অ্যাবরশন করা ভ্রূণতে। পাঁচটা বড় কুকুর আছে পাটিল দের। তাদের খাবার ই হল ওই-- ডেড ফিটাস!

বমি সামলাতে মুখ চাপা দিই আমি। মাথা ধরার উপর গা গুলিয়ে ওঠে।

খারাপ লাগল ম্যাডাম, বঝতে পারছি। নাজুক মন আপনাদের। আমরা লুকিয়ে ক্যামেরা নিয়ে গিছিলাম, কুকুর গুলোকে লেলিয়ে দিয়েছিল আমাদের উপর। কোনও মতে প্রাণ নিয়ে ফিরেছি। আমাদের নালিশ পুলিশ নিলনা, কিন্তু পাটিলের দেওয়া ট্রেসপাস কেসের এফ আই আর হয়ে গেল। আমরা পারমিশন না নিয়ে ঢুকেছি তাই ট্রেসপাস। একই পুলিশ, একই থানা। কি বলবেন?

আমার খুব অবসন্ন লাগছিল। জল পাইনি। দুপুরে খাওয়া জোটেনি। বাঙালি সাংবাদিক কত আর মজবুত হবে। অবস্থা দেখে যশোবন্ত্ আমাকে একটা রেস্তোঁরায় নিয়ে গেলেন গলির ভিতর। চা জল। চিঁড়ের পোলাও। কিছু মিষ্টি। রাত দশটার পর দূর পাল্লার বাস ছাড়ে পুণের জন্য। বললেন, তাতে গিয়ে বসিয়ে দেবেন। এই জেলা শহরে রাতে কোনও হোটেলে থাকতে আপনার ভাল লাগবেনা , সে আমি জানি।

না, না, আমি আকুল হয়ে উঠি। ফিরতেই হবে আমাকে। এ বধ্যভূমি ছেড়ে যত দ্রুত চলে যাওয়া যায়।
তবে, আপনি আর কস্ট করবেন না। আমি একটা রিক্শা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড চলে যেতে পারব।

উঁহু, মণীষা তাঈ তাহলে মুখ দেখবেন না আমার। আপনার সেফটি আমাদের দায়িত্ব।
তবে ফেরার আগে এক জায়গায় নিয়ে যাব আপনাকে। এ কাজে আমি কি ভাবে জড়ালাম আপনি বুঝতে পারবেন। একজন ঢাবা অলা কি ভাবে অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে গেল-- জানবেন না?

অ্যাক্টিভিস্ট কথাটায় খুব চাপ দিল যশোবন্ত, যেন ওটা একটা বিদ্রূপ।

শহরের উল্টোপ্রান্তে এক খেলার মাঠ ঘেঁষে সারি সারি পাকা বাড়ী। একতলা। বড়সড়। কিন্তু টালির চাল। হয়তো কোনও স্কীমের আওতায় এক ধাঁচে বানানো। মাঠ টা খুব শ্রীহীন। ঘাস উঠে গিয়ে প্রায় ন্যাড়া।
একটি বাড়ীর সদর দরজা আমপাতা ও গাঁদার মালায় সাজানো। কলাগাছ, পূর্ণঘট দরজার দুপাশে।
দরজা খুলে যশোবন্ত কে দেখে হই হই করে উঠল সবাই।

আধঘোমটা দেওয়া মহিলা, মেয়ের মা, লজ্জাবতী যুবতীর মত জল মিষ্টি আনছেন। এঁর মেয়ের বিয়ে কাল।
কই ডাকো, দু্র্গা কে ডাকো না!
বিয়েবাড়ী তে কোন উপহার ছাড়া এসে খারাপ লাগছে।
যশোবন্ত ফিস ফিস করে বলল, আরে আপনার আসা টাই তো ওর গিফ্ট। ওর স্টোরি লিখবেন তো আপনি?
বাইশতেইশ বছরের শ্যামলী মেয়ে, হাসি খুশি, বেণী বাঁধা চুল, এসে পা ছুঁল যশোবন্তের। এই হল দুর্গা। বিয়ের কনে।আমাকে প্রণাম করার আগেই আমি ওর হাত ধরে ফেললাম। দুর্গাকে আদর আশির্বাদ করে যশোবন্ত্ উঠল।

আমি কাল আসব রে আবার।

দূর পাল্লার বাসের চেয়ার একটু হেলানো যায়। যশোবন্তের দেওয়া পুরী সবব্জি খেয়ে ভাবছি, ঘুম তো আসবেনা। তার চেয়ে স্টোরিলাইন টা ভাবি। গল্পটা মণীষা আত্রের। যশোবন্ত ঢাবা অলার। অজাত বিনষ্ট সব মেয়ের। আর দুর্গার। তা মায়ের ও।
পরদেশী যুবক যশোবন্ত ভালবেসেছিল তরুণী শকুন্তলাকে। চোখের দেখার ভালোবাসা আড়ালেই রয়ে গেল। এদেশে তো জাত গোত্র মেনে বিয়ে হয়। শকুন্তলার বিয়ে হল চাষিবাসি গোবিন্দর সংগে। সম্বন্ধ করে। তখননতুন জীপ কিনেছে যশোবন্ত। এখানে ওখানে যেত। লোকে ডাকত ওকে কাজে কর্মে, বিয়ে থার যোগাড়ে। ঢাবা জমে উঠছে। যুবক বয়স। নতুন জীপগাড়ী। হাসপাতালেও রোগী পৌছেচে কতবার। শকুন্তলার প্রসবের ব্যথা উঠলে ওরা খবর দিল যশোবন্ত কে।
শকুর স্বামীটাকে আমার কোনওদিন পছন্দ হয়নি। না না হাসবেন না, সেজন্য না। গোবিন্দ মানুষটা ভাল ছিল না। ও মরে বেঁচে গেছে শকু।
সে রাতে হাসপাতালে আমার মন টা কু ডাকছিল। ওদের পৌছে আমি ফিরে আসিনি। অপেক্ষা করছিলাম। মনে মনে নানা পাঠ আওড়াচ্ছি। হনুমান চালিসা। রামরক্ষা। প্রসব ভালভাবে হয়ে যাক এই চাইছি। এই দুনিয়ায় কে যে কার জন্য ভগবান কে ডাকে!

ছোট হাসপাতাল। কটা আর কেস। শকুর প্রসব ব্যথার চীৎকার শুনছি বাইরে দাঁড়িয়ে আব ভাবছি হে দেবতা রক্ষে করো শকুকে। একটু পরে নতুন জন্মানো বাচ্ছার কান্নায় ভরে গেল আকাশ। আমার দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে আপনা থেকেই। বাচ্ছা আরও কাঁদল খানিকক্ষণ, তারপর কি শকু ওকে দুধ খাওয়াতে বুকে নিল, কে জানে, কোনও সাড়াশব্দ নেই। কেমন যেন অদ্ভুত চুপচাপ সব।

বেঞ্চিতে বসে চোখ লেগে গেছিল, হঠাৎ মনে হল দূরে কোনও দমচাপা কান্নার শব্দ-ছোট শিশুর--

আমার তো কুটিল মন, গোবিন্দ কে বিশ্বাস করিনা, ছুটে গেলাম ওয়ার্ডের পিছন দিকে, ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়, কাঁথা কাপড় জড়িয়ে একতলার জানলা দিয়ে একটা নতুন বাচ্ছাকে ফেলে দিয়েছে নীচে। কাপড় চাপা কান্নার শব্দ-- কেউ শোনেনি,আমি শুনেছি। ওই জায়গাটায় মাটি কাঁচা, শেয়াল সাপ খোপ সব ঘোরে রাতের বেলা--

তারপর?

আমিও রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়।

তারপর নতুন জন্মানো মেয়ে কে তুলে নিয়ে শকুর কোলে ফেরৎ দিলাম। গোবিন্দকে পুলিশের ভয় দেখালাম। দুর্গাঅষ্টমীর রাতে জন্ম। তাই ওর নাম দিলাম দুর্গা। এদেশে অত দুর্গাপুজোর জাঁকজমক নেই, বিহারে বাংলায় যতটা। বললাম নাম রাখব আমিই। ও আমারই মেয়ে। গোবিন্দ কি ভাবল কে তার পরোয়া করে?
কাল আমার সেই দুর্গার বিয়ে। গোবিন্দ বেঁচে নেই। আমি আর শকুন্তলা মিলে সব জোগাড় যন্তর করেছি বিয়ের।
হ্যাঁ, তারপর তো সময় দেখতে দেখতে আরো খারাপ হল। যন্ত্র এল, মানুষের লোভ বাড়ল, ডাক্তাররা যম বনে গেল, আর আমিও মণীষাদিদির চেলা অ্যাকটিভিস্ট হয়ে গেলাম-- হা: হা:!
বাস ছাড়ার আগে আমি বললাম--
সকালে আপনি বলছিলেন সব শেষ। ওরা আপনার হোটেল ভেঙে দিল, রুজি কেড়ে নিল, তবু শেষ তো হয়নি যশোবন্ত্। বরং শুরু হল তো!

স্টোরিটা অবশ্য নিলনা আমার কাগজ। তাই দুর্গাকে বিয়ের উপহার ও দেওয়া হলনা শেষপর্যন্ত। চীফ এডিটর বললেন, হাউসের পয়সা নষ্ট করে কি করে এসেছ তুমি! এখন চাষিদের আত্মহত্যা, অপুষ্টিতে শিশুমৃত্যু এসব ট্রেন্ড করছে। সার্প্রাইজ দেওয়ার মরসুম নয় এটা। গ্রীষ্মের শুরু। তা ছাড়া যে মেয়েরা জন্মায়নি তাদের আবার গল্প কি?

তাই ভাবছি, গল্পটা কে নিয়ে কি করি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ