আঠারো বছর ধরে লেখা হয়েছে সঙ্কলনটির নানা গল্প। মূলত কিশোরদের জন্য। শেষে, লেখাগুলি সাজাতে গিয়ে লেখক ও প্রকাশকের মনে হয়েছে, সব বয়সের পাঠকদের জন্য লেখাগুলি খুলে দেওয়া যাক। ঠিক সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞানচেতনা, প্রখর সৃষ্টিশীলতা, স্বপ্ন দেখার সাধ আর দারুণ রসবোধ— এই সব মিলেমিশে আত্মারামের নতুন খাঁচা বইটিকে পরিণত করেছে এক দুর্নিবার মেধা সম্পদে।
র্যালফ ফক্স-এর রাজনৈতিক দর্শন বা সক্রিয়তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। এমনকি, উপন্যাসের ব্যাকরণ নিয়ে ১৯৩৪ সালে লেখা তাঁর বই দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য পিপল-এর সঙ্গেও কিছু বিপক্ষতা সম্ভব। কিন্তু, “ব্যক্তিবিশেষের নিয়তিকে উপন্যাসের রূপ দিতে হলে সমগ্রের একটা অবিচল ধারণা থাকতে হয়”, তাঁর এই উপলব্ধিকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। উপন্যাস তো ‘কেবল কল্পনাশ্রয়ী গদ্য নয়’, উপন্যাস হচ্ছে “মানুষের জীবনের গদ্য; মানুষকে সমগ্রতায় গ্রহণ করা ও তাকে সেই ভাবে রূপ দেওয়ার ব্যাপারে প্রথম শৈল্পিক প্রচেষ্টা।”
দৈনন্দিন যাপনের আলো-অন্ধকার পেরিয়ে আরও এক স্পর্শযোগ্য জীবন বয়ে যায় ভিতরে, নৌকার চালে। কখনও তাপমাত্রার হেরফেরে হিমশৈলের মতো তার আভাসটুকু নাক উঁচিয়ে থাকে জলের উপরে। চকচকে, বানানো, আরোপিত নয়, এই স্রোতে অহরহ ভেসে চলে অগণন কাগজের নৌকা। তা অফুরন্ত, অথচ জিওল। বিকেলের আলো-লাগা স্তিমিত আলো দিয়ে তৈরি তার শরীর। নিঃসীম জীবনের মাঝে বিপন্ন মানুষের মুখে সেই বেঁচে থাকার আলো পড়ে। তৈরি হয় একের পর এক জাদু নকশা।
অজানা ভূখণ্ডের অচেনা লোকজন, তাদের ভাষা, খাওয়া-পরা, ধরন-ধারণ সবই অন্য রকম। তাদের উদ্বেগ-অসহায়তা বুকের মধ্যে অনুভব করতে হয় চাই সাহিত্য-সিনেমা, নইলে রাজনীতি। ‘কাস্তে’ বইটিকে বলা চলে রাজনৈতিক সাহিত্য। বিষয়বস্তুতে তো বটেই। প্রাকৃতিক সম্পদ, রাষ্ট্রের সম্পদ থেকে গরিবকে দূরে রাখার যে নিপুণ কার্যক্রমটি রাজনীতি পোষণ-তোষণ করে চলেছে, তা নিয়ে এই উপন্যাস। আখ্যান-নির্মাণের রীতিটিও রাজনীতি-প্রণোদিত। চরিত্রদের (অধিকাংশই হতদরিদ্র) জ্ঞান-বুদ্ধির নাগালে যা নেই, তা-ও যাতে পাঠক জানে-বোঝে, সেই তাগিদে লেখক কথাসাহিত্যের জঁর-বন্দি হয়ে থাকেননি। কাহিনির খোলে তথ্যের পুর গোঁজার ভনিতা না করে তদন্ত-রিপোর্টের ধাঁচে লিখেছেন, মরাঠাওয়াড়ার চিনি সমবায়ের নেতা-চাষিরা আখ-কাটা শ্রমিককে কী ভাবে দাস-শ্রমিকে পরিণত করছে। কেমন করে ব্যাঙ্ক তুলোচাষিকে ঋণ শোধের সুযোগ না দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে দড়ির ফাঁসের দিকে। নেতা-পুলিশের প্রশ্রয়ে চলছে কন্যাভ্রূণ হত্যা।
নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের ধারায় নতুন একটি সংযোজন অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘মহানদী’ (২০১৫)। নদী-নির্ভর বাংলা উপন্যাসের পরিধি অনেকটা ব্যাপ্ত হল ‘মহানদী’র সূত্রে। বাংলার বাইরের বহমান কোনও নদী নিয়ে বাংলায় এরকম উপন্যাস সম্ভবত আগে কখনও লেখা হয়নি। শুধু এই কারণেই ‘মহানদী’ এবং তার রচয়িতা অনিতা অগ্নিহোত্রী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাঙালি পাঠকের কাছে।
বাংলার সমকালীন কথাকারদের মধ্যে অনিতা অগ্নিহোত্রীর একটি স্বতন্ত্র জায়গা আছে। প্রথমাবধি তাঁর ছোটবড় গল্পে, উপন্যাসে দেখা যায় ভারতবর্ষের নিজস্ব মুখ। ভাঙাচোরা, ক্লান্ত, ‘মহান ভারত’-এর বাইরে, ভিড়ে মিলেমিশে থাকা অথচ নিজের মধ্যে নিজেই স্বস্থ মানুষ আর তার সামান্য জীবন রূপ পায় অনিতার অক্ষর ধরে ধরে। সে জীবন অনেক দেখেছেন তিনি। যত্নে দেখেছেন, যত্নে লিখেছেন। আর, সেই যত্নের সবটুকু যেন উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর বিশাল উপন্যাস মহানদী-তে।